প্রিয় পাঠক আপনারা অনেকেই হয়তো করম উৎসব নামটি শুনেছেন। এই করম উৎসব আসলে কি এবংকরম উৎসবের সময়সূচী সম্পর্কে আজকে আপনারা জানতে পারবেন। কথাতেই আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন, এই পার্বণগুলো সম্পর্কে আমরা অনেকে জানি আবার অনেকে জানিনা সেই পার্বন গুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম গুলিতে এই করম পরব উৎসব দারুনভাবে জনপ্রিয় এই উৎসবটি কারা পালন করেন এবং এই উৎসবটি আসলে কি সেই সম্বন্ধে জানবো এই প্রবন্ধের মাধ্যমে।
এই করম পরব উৎসব টি ভারতের ঝাড়খন্ড, বিহার, ছত্রিশগড়, উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গে জমি থেকে ফসল কাটার পর এই উৎসবটি পালন করা হয়। এই উৎসবের মাধ্যমে করম দেবতাকে শ্রদ্ধা জানানো হয়, মনে করা হয় ইনি শক্তি, যুব এবং যৌবনের দেবতা।
![karam Fastible](https://namerartho.in/wp-content/uploads/2023/09/bdc57e6820f8e161320bee36b77e5b59-1.webp)
মূলত এই করম উৎসব টি আদিবাসী এবং সাঁওতাল উপজাতিদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়। এদের মধ্যে রাজপুত, লোহার, বাউরী, হাড়ি, বাগদী, বেদে মুন্ডা, ওরাও, হো, মাহালি ইত্যাদি সম্প্রদায় গুলির জঙ্গল ক্রেন্দিক এবং কৃষিভিত্তিক একটি লোকউৎসব।
করম উৎসবের সময়সূচী
করম পরবের সময়সূচী টি একটি বিশেষ দিনে পালন করা হয়, প্রত্যেক বছর ভারতীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ভাদ্র মাসে শুক্র একাদশীতে করম পরব উৎসবটি পালন করা হয়। শুক্ল একাদশীর এক সপ্তাহ আগে থেকে মেয়েরা ভোরবেলা উঠে শাল গাছের ডাল ভেঙে বা করম গাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পুঁতে দেয় এরপর থেকেই করম পরব উৎসবের সূচনা হয়।
করম পরব পালনের রীতি
সাধারণভাবে গ্রামের অবিবাহিত মহিলা অর্থাৎ কুমারী মেয়েরা এই করম ঠাকুরের উপাসনা করে থাকে। উৎসব শুরুর সাত দিন আগে থেকে অর্থাৎ শুক্লা একাদশীর সাত দিন আগে থেকে গ্রামের কুমারী মহিলারা বাঁশ দিয়ে বোনা টুপা অর্থাৎ বালতি জাতীয় জিনিস যা বাঁশ দিয়ে বোনা এগুলিকে নিয়ে ভোরবেলায় সকলে একত্রিত হয়। বাড়ি থেকে আনা বিভিন্ন শস্য বীজ গুলি নিয়ে ভোরবেলায় নদীতে অথবা ঝিলে স্নান করতে যায় এবং স্নান করে আসার সময় ওই টোপা করে বালি নিয়ে আসে।
![করম উৎসবের সময়সূচী](https://namerartho.in/wp-content/uploads/2023/09/Karam-Puja.webp)
এরপর অবিবাহিত মহিলারা ভিজে কাপড়ে বাড়ি থেকে আনা বীজগুলি শাল পাতার ওপর টোপা করে আনা বালি ছড়িয়ে বুনে দেয় এবং তাতে সিঁদুর ও কাজলের তিনটি দাগ টানা হয়,যাকে ওদের ভাষায় বাগাল জাওয়া বলা হয়। এরপর বুনে দেওয়া শস্য বীজগুলির চারিপাশে সকলে মিলে গোল করে ঘিরে আদিবাসীদের গান গাইতে থাকে। আমরা গানের কিছু লাইন আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।
ভাদর মাসে করম পরব
মুদের ঘরে ঘরে
বাঁজা মাটি গাভিন হবেক
বীজের ফোড়্যে ফোড়্যে ।
দাঁতন কাঠি বাঁশের টুপা
বালি ভরা ডালা
ডালা ঘিরে বিটি ছিল্যার
জাওয়া গানের পালা ।
তেল হলুদে কুত্থি জুনার
সিঁদুর কাজল লাগা
শাল পাতায়্যে বাঁট্যে দিয়ে
বাঁশ কঞ্চির দাগা ।
সিনান সারে ঝিঙাপাতায়
করম উৎসবের ব্রত পালন
এরপর জাওয়া টোপা গুলোর পরিচর্যা করতে থাকা হয় এবং দু একদিন পর সেই শস্য বীজগুলির অংকুর বের হয়। জাওয়া পাতানো কুমারী মেয়েরা শ্রদ্ধা জানাতে এই সাত দিন ধরে তাদের রীতি পালন করে প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলায় ব্রত পালনকারী মহিলারা নিজের ‘ডালা’ সাথে নিয়ে গ্রামের এক প্রান্তে একত্রিত হয় এবং এই ‘জাওয়া’ কেন্দ্র করে সন্ধ্যাবেলা তাদের ঐতিহ্যবাহী গান এবং নাচ করে।
এই সাত দিন তাদের নানান রীতিনীতি পালন করার পর শুক্ল একাদশীর দিন পরম পূজা চালু হয়। এই দিন ব্রত পালনকারী মহিলারা সকাল থেকে উপবাস করে এবং একসাথে জঙ্গলে গিয়ে ফুল এবং পূজার যাবতীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে থাকে, এর মধ্যেই সারাদিন তারা গান এবং নৃত্যের মধ্যে দিয়ে কাটায়।
এদিন সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের ‘লায়া’ অর্থাৎ পুরোহিতরা একটি জায়গায় করম ডাল পুতে করম ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা করে। সুন্দর করে শাল গাছের পাতা এবং ফুল দিয়ে ঠাকুরের বেদীটিকে সাজানো হয়। ব্রত পালনকারী মহিলারা করম পূজার ডালিতে সিঙ্গুর,আতপ,চাল,ঘি,গুড়,মধু, ‘কাঁকুর’, এক গোছা ধান নিয়ে পুরোহিতের কাছে দেন এবং তারা কামনা করে ভালো স্বামী পাওয়ার এবং সন্তানবতী হওয়ায়। কুমারী মেয়েরা কাঁকুরকে পুরুষ হিসেবে মানে।
![karam puja](https://namerartho.in/wp-content/uploads/2023/09/karamapuja-65-1-1024x576.webp)
করম দেবতা প্রতিষ্ঠানের পরের দিন সকালে কুমারী মেয়েরা জাওয়া থেকে অংকুরিত বীজগুলিকে তুলে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়, এবং বিভিন্ন স্থানে সেগুলিতে রোপন করে। এই পর্বের শেষে করম ডালটিকে জলের মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। পুজো শেষের পড়ে মেয়েরা একে অপরকে করমডোর বা করম রাখি পরিয়ে দেয়। এরপরে পাশাপাশি পুকুর অথবা নদীতে পূজার সমস্ত কিছু ও ‘কাঁকুর’ বিসর্জন দেয়া হয়।
করম উৎসবের গান ও নাচ
এই করম উৎসবের প্রধান বিষয় হল গান, এই গানগুলি বিশেষ কোনো বইয়ে বা পুঁথিতে লেখা নেই তবে বংশের পরম্পরা অনুসারে গানগুলিকে মুখে মুখে গাওয়া হয়। এই গানগুলোর মাধ্যমে নারীদের মনের বিশেষ অনুভূতি পাওয়া যায়। গানগুলি গাইতে গাইতে চলে করম নৃত্য। ‘জাওয়াকে’ কেন্দ্র করে কুমারী মেয়েরা গোল করে ঘিরে নৃত্য করে। দৈনন্দিন জীবনে হাসি কান্না সুখ দুঃখ এই গানের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে, বাংলা লোকসাহিত্যে অমূল্য সম্পদ হিসেবে এই গানগুলিকে ধরা হয়।
গরম উৎসব প্রধানত সূচনার উৎসব, সৃজনশীলতার উৎসব, এই করম শব্দটি কর্ম থেকে উৎপত্তি হয়েছে। ঝাড়খণ্ডের বেশ কিছু জায়গায় এই উৎসবটি ‘কর্মা’ নামে পরিচিত। এই উৎসবের সূচনা জাওয়া পাতার মধ্য দিয়ে এখান থেকেই বোঝা যায় উৎসবটি সৃজনশীলতায় পরিচয় দেয়।